২০১৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বরাতে একটি খবর প্রকাশ করে দ্য ডেইলি স্টার। খবরটির শিরোনাম ছিল, Joy receives ‘ICT for Development Award। খবরটির বিস্তারিত অংশে বলা হয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে অনবদ্য অবদান রাখায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়েছে। ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড কমপিটিটিভনেস, প্ল্যান ট্রিফিনিও, গ্লোবাল ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাভেনের স্কুল অব বিজনেস যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশন উপলক্ষ্যে এ বছর চালু করা হয়েছে পুরস্কারটি। প্রতিবছর এই পুরস্কার দেওয়া হবে। রবার্ট ডাভি নামের একজন অভিনেতা পুরস্কারটি জয়ের হাতে তুলে দেন এমন একটি ছবিও দেখা যাচ্ছে।
খবরটি আওয়ামীলীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটসহ এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া এই পুরস্কার পাওয়ার পর সরকারি সংবর্ধনা ও জেলায় জেলায় আনন্দ মিছিলের আয়োজনও করেছিল আওয়ামীলীগ ও তার একাধিক অঙ্গসংগঠন।
সরকার কর্তৃক আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জয় বলেন, “‘আমার মতে- বিশ্বে আর কোনো দেশ নেই, এতো অল্প সময়ে নিজেদের মেধা ও অর্থ ব্যবহার করে ডিজিটালাইজেশন করেছে। এখন জাতিসংঘ আমাদের ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ধরছে। এতো অল্প সময়ে কীভাবে আমরা সাফল্য অর্জন করলাম, অন্যান্য দেশ এ বিষয়ে জানতে চাচ্ছে।’ কিন্তু জাতিসংঘের একটি মিটিং রুমে প্রদত্ত কোনো পুরস্কার জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট নয়।
শেখ হাসিনা ও জয়ের পুরস্কার হাতে একটি ছবিও দেখা গেছে তখনকার খবরে। কিন্তু ছবিটি ছিল আংশিক। আরো সার্চ করে এই ছবিটির একটি পুর্ণাঙ্গ ভার্সন পাওয়া যায় জাতিসংঘের বাংলাদেশ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে। সেখানে একদম ডান পাশে দেখা যাচ্ছে একজন ব্যক্তিকে। যিনি এই পুরস্কারের উদ্যোক্তা কিন্তু হলিউড অভিনেতার পুরস্কার তুলে দেয়ার কথা বলা হলেও মিডিয়ায় আসেনি পুরস্কারদাতা প্রতিষ্ঠানের এই কর্তাব্যক্তি। ওসিসিআরপির বরাতে জানা যায়, তার নাম ক্যারি ইয়ান।
সম্প্রতি সংগঠিত অপরাধ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশকারী প্লাটফর্ম ওসিসিআরপিতে এই ক্যারি ইয়ানকে নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ক্যারি ইয়ান এবং গিনা ঝৌ মূলত একটি প্রতারক চক্রের অংশ, যারা বিভিন্নভাবে ঘুস দিয়ে জাতিসংঘে প্রোগ্রাম করে বিভিন্ন দেশের সরকারি ব্যক্তিদের ভেড়ানোর চেষ্টা করে। এভাবে তারা ১০ মিলিয়ন ডলার এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ডিপ্লোম্যাটদের পেছনে খরচ করেছে। মূলত নাসা কর্তৃক অনুমোদিত দাবি করে ভুয়া পানির ব্যবসাকে জনপ্রিয় করার জন্যই এই যোগাযোগকে দৃঢ় করার চেষ্টা করেন তারা। এছাড়া ইতিমধ্যে মার্শাল আইল্যান্ডের রাজনীতিবিদদের ঘুস দিয়ে সেখানে একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে ব্যবহার করতে চাইছিল এই ইয়ান-ঝৌ।
কে এই ইয়ান-ঝৌ?
ওসিসিআরপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ক্যারিয় ইয়ান চীনা আনহুই প্রদেশে একজন গরিব ঘরের সন্তান। কিন্তু বড় হয়েছেন হিসেবে ভিন্ন এক পরিবারে। সেখানে তার পালিত বাবা-মা’র মৃত্যু হলে তিনি তার আসল পরিবারে ফিরে আসেন এবং ভীষণ দরিদ্র অবস্থায় ছিলেন। ভাল ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাদীক্ষায় ভাল করে একসময় ব্যবসা-পরামর্শক হিসেবে বেশ সফলতা লাভ করেন। কিন্তু পাশাপাশি চলতে থাকে নানারকম প্রতারণা। দুই ভাই মিলে শুরু করেন এসএসজি মিনারেল ওয়াটার নামে সর্বরোগের ঔষধ, যা পরবর্তীতে চীনা আদালতে ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। এভাবে একসময় প্রতারণায় বাধা আসতে থাকলে ইয়ান রওনা দেন অ্যামেরিকায়। এর আগেই চীনে পনের হাজার টাকা দামের এই ভুয়া সর্বরোগের ঔষধ বিক্রির নামে অন্তত ২০ হাজার ব্যক্তির থেকে অর্থ লুটে নিয়েছেন এই ইয়ান, জানিয়েছে চীনা আদালত।
এরপর ইয়ান সিলিকন ভ্যালিতে পৌঁছান আন্তর্জাতিকভাবে পণ্যটি প্রচার করতে। সেখানে, তিনি দেখা পান ঝৌ নামে এক নারীর। ঝৌ ইতিমধ্যে শিক্ষার্থী হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এরপর তারা একসাথে হয় এবং ইউএস এলিগেন্টে কাজ শুরু করেন। ঝৌ ইংরেজিতে সাবলীল ছিলেন এবং তিনি শীঘ্রই তার সঙ্গীর ডান হাত হয়ে ওঠেন।
এই চক্রান্তে বাংলাদেশের নাম এলো যেভাবে
ইয়ান-ঝৌ দম্পতি নানাভাবে জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে ছবি তুলতেন। এসব ছবি তোলার কাজে এবং জাতিসংঘের ভেতরে নানা যোগাযোগ তৈরির জন্য একজন কূটনীতিককে ঘুসও দেন। সেই ব্যক্তির নাম ফ্রান্সিস লরেঞ্জো, যিনি ডোমিনিকান রিপাবলিকের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন এবং তাকে দেয়া ঘুসের পরিমাণ ছিল প্রায় ১.৩ মিলিয়ন ডলার। কথা ছিল, জাতিসংঘের এসব যোগাযোগকে আরো দৃঢ় করা। সেটি করতে যেয়ে তাদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল, একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত করা। কিন্তু দেখা যায় সেটি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। সহজ রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে সমাধান এলো, ইতিমধ্যে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে তালিকাভুক্ত আছে এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের আওতায় নিয়ে আসা। পরে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একটি এনজিওকে নানাভাবে টোপ দিয়ে নিজেদের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয় চরম ধুরন্ধর ইয়ান এবং ঝৌ। ওয়ার্ল্ড অফ হোপ ইন্টারন্যাশনাল নামের সেই এনজিওটি হয়ে যায় ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড কমপিটিটিভনেস। এই কাজে ইয়ান মোট ঘুস দেন প্রায় এক মিলিয়নের কাছাকাছি যা ইতিমধ্যে আদালতে উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত হওয়ার পর তাদের প্রথম কাজ ছিল, যেকোনো একটি দেশের অতি ক্ষমতাশীল কাউকে এনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সবার নজর কাড়া। তারই ধারাবাহিকতায় তারা প্রথম অনুষ্ঠান আয়োজন করে ২০১৬ সালে এবং সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে প্রধানমন্ত্রী মূল বক্তাও ছিলেন। যদিও ওসিসিআরপি থেকে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা কোনো জবাব দেননি।
ওসিসিআরপি আরো জানায়, এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে অনেক চীনা ব্যবসায়ীও অর্থ দিয়ে থাকেন। মূলত ইয়ান-ঝৌ জুটি যেন সর্বত্র নিজেদের ‘জাতিসংঘের লোক’ হিসেবে আরো বেশি যোগাযোগ বাড়িয়ে নতুন নতুন প্রতারণার কৌশল নিতে পারে তারই অংশ এটি। একইভাবে সুরিনামের সরকারকেও তারা ২০১৭ সালে আরেকটি বড় অনুষ্ঠানের জন্যে রাজি করিয়ে ফেলে। এমনকি এসব অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্যের ভিডিও যুক্ত করে প্রচার করা হয় যা মূলত ভিন্ন অনুষ্ঠানে নানা সময়ে দেয়া বক্তব্যকে প্রতারণামূলকভাবে যুক্ত করে নিজেদের অনুষ্ঠানকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলছে সরকারি এসব আয়োজনে বহু দেশের কূটনীতিক-মন্ত্রীদের ঘুস দিয়েছে ইয়ান-ঝৌ জুটি। নর্থ ইস্ট নিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেয়া হয় যে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন কাজ করা মাসুদ বিন মোমেনের মাধ্যমেই এই জুটি হাসিনা-জয়কে দিয়ে তাদের জাতিসংঘ সংক্রান্ত প্রতারণার স্কিমের প্রথম অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে তাদের অপরাধের বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর ২০২০ সালে থাইল্যান্ডে গ্রেফতার হন তারা। ইয়ান এখনো জেলে থাকলেও ঝৌ সম্প্রতি মুক্তি পেয়ে আশ্রয় নিয়েছে মার্শাল আইল্যাণ্ডে। তাদের ব্যাপারে আরো তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে ওসিসিআরপি।