বিজয়ের সেকাল – কিছু অপ্রিয় কথা

মেজর শাফায়াত আহমদ (অব:)

পূর্বকথা

প্রতি বছর ডিসেম্বর মাস আসলে বাংলাদেশ জুড়েই একটা অন্যরকম তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য, এই তোড়জোড়ের মূল উপলক্ষ ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে অর্জিত সেই বিজয়কেই যেন নতুন করে অনুভব করার পুনঃ পুনঃ প্রচেষ্টা। নয় মাসের যুদ্ধ আর বেশুমার রক্তপাতের পর অর্জিত এই বিজয়ের স্বাদ বারবার নেওয়াই যায়! আজ এত বছর পরেও আমরা সেই বিজয়কে উদযাপন করতে চাই, বারবার বিজয়ের সেই মুহুর্তগুলোতে হারিয়ে যাতে চাই; না জানি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা সেই সময়টায় কি ভাবছিলেন!

এই চিন্তা থেকে হঠাৎই মনে হল একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখি সেই দিনগুলোতে; অর্থ্যাৎ ১৬ ডিসেম্বর ও তার ঠিক আগে ও পরের সময়টাতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বা সেই সময়ের বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষেরা কি দেখছিলেন, কি ভাবছিলেন আর কিইবা উপলব্ধি করছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বা এর ঠিক আগে-পরের এই সময়টাতে আমাদের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা যা ভাবছিলেন তার কতটুকু আশাবাদ ছিল আর কতটুকু আশঙ্কা ছিল? এই মানুষগুলোই এর আগের নয়টি মাস পরিবার ছেড়ে, আপনজনদের কথা না ভেবে নিজের জীবন বিপন্ন করে নিরন্তর যুদ্ধ করে গিয়েছেন। কেউ হয়তো ফিরে এসে পরিবারকে খুঁজে পান নি; কেউ হয়তো ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু তাদের এই সমস্ত আত্মত্যাগ যে কারনে, অর্থ্যাৎ যে স্বাধীন দেশটা পাওয়ার জন্য; সে দেশে ফিরে তারা কি ভাবছিলেন; সেই কৌতুহল থেকে ফিরে গিয়েছিলাম ইতিহাসের পাতায়।

তবে ইতিহাসের পাতায় ফিরে যাওয়ার এই প্রচেষ্টাটা বিনা কারনে নয়। ৫২ বছর আগের মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে দেখা বাস্তবতা আর চিন্তার সাথে আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা আর এখনকার মানুষের চিন্তা-ভাবনাগুলোর মাঝে একটা যোগসূত্র বের করার ইচ্ছা কাজ করছিল মনে। আর এই যোগসূত্রটাই আজ; ১৯৭১ এর বিজয়ের ৫২ বছর পরে আমার ১৬ ডিসেম্বর ভাবনা।

বিজয়ের সেকাল

১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন অন্যতম বৃহৎ মহকুমা ময়মনসিংহ স্বাধীন হয়। স্বাধীন হওয়া মাত্রই সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে একজন ডিসি ও দুজন এডিসি জেলা জজের বাসভবনে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে দেন। ৩০০ মুক্তিযোদ্ধাসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড ময়মনসিংহে অবস্থান গ্রহণ করে। মিত্রবাহিনীর অংশ হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অবস্থান তখন স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু যেটা অস্বাভাবিক ছিল তা হচ্ছে, পিকে ব্যানার্জি নামের একজন আইএএস অফিসারের উপস্থিতি। তিনি ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে এসেই ময়মনসিংহের ডিসিকে ডেকে পাঠালেন। তার এহেন কর্তাসুলভ হম্বিতম্বি দেখে এডিসিবৃন্দ হতবাক হয়ে যান।

প্রতিষ্ঠিত প্রটোকল অনুযায়ী, সফরকারী কর্মকর্তা সমান মর্যাদার কিংবা নিম্নপর্যায়ের হলে ডিসির অফিসে কিংবা তার বাসভবনে, অথবা যেখানে ডিসি তাকে সময় দেবেন, সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা। শুধু ডিসির চেয়ে উচ্চ পদের কর্মকর্তারা ডিসিকে ডেকে পাঠাতে পারেন। এই আইএএস অফিসার ভিনদেশি। তার ক্ষেত্রে পদমর্যাদানির্বিশেষে তাকে এসেই ডিসির সঙ্গে দেখা করতে হবে। তা ছাড়া ময়মনসিংহে আসা এই অফিসার কোনক্রমেই ডিসির চেয়ে সিনিয়র হবেন না, হলে তিনি ঢাকা সচিবালয়ে যেতেন। যাই হোক, এডিসিবৃন্দের পরামর্শে ডিসি তার অফিসে চলে যান আর সেখানেই পিকে ব্যানার্জি তার সাথে দেখা করেন।

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভারতীয় বাহিনীর ক্রিয়াকলাপের কাহিনী চাউর হতে শুরু করে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরির অনেক দামি সরঞ্জামাদি ট্রাকে ভরে ভারতে পাচার করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আসে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের চোখের সামনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ব্যবহার্য নতুন মার্সিডিজ গাড়িটিও ভারতীয় ব্রিগেড কমান্ডার ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে চলে যান। ময়মনসিংহের নবনিযুক্ত ডিসি খসরুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় বেশ বলিষ্ঠ ভূমিকা নেন। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র উভয় মন্ত্রণালয়ে তিনি বেশ কঠিন ভাষায় এব্যাপারে চিঠি লেখেন এবং তার এই সাহসী পদক্ষেপের কারনে গাড়িটি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাওয়া যায়।

এর কিছুদিন পর ঢাকায় সেই ভারতীয় আইএএস অফিসার পিকে ব্যানার্জি এক বিদায়ী নৈশভোজে ময়মনসিংহের এডিসিবৃন্দের মুখোমুখি হন। ততদিনে সেই দুই এডিসির ঢাকায় বদলি হয়ে গেছে। তারা পিকে ব্যানার্জির কাছে ভারত সরকার কর্তৃক তাকে ময়মনসিংহে পাঠানোর কারন জানতে চান। কিছুটা ভূমিকা করে ব্যানার্জি বলেন, ভারত সরকার পুর্ব পাকিস্তানের বিদ্যমান ১৯টি মহকুমার দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য আগে থেকে ১৯জন প্রশাসন কর্মকর্তাকে মনোনীত করে রেখেছিল এবং সে মোতাবেক কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং এ তাদের পশ্চিম বঙ্গের মুখ্য সচিব ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন লেঃ জেনারেল ব্রিফ করেন। তাদের প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিভিন্ন মহকুমার প্রশাসন কর্মকর্তারা নিহত হবেন এবং প্রশাসনে বিশাল শুন্যতা দেখা দেবে; সেজন্যই সেই সংকট মোকাবেলাই এই আগাম প্রস্তুতি!

চুড়ান্ত বিজয়ের একদিন আগে, অর্থ্যাৎ ১৫ ডিসেম্বর রাতে মিত্র বাহিনীর প্রথম ইউনিট হিসেবে তৎকালীন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (বীর বিক্রম, পরবর্তীতে মেজর জেনারেল ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, প্রয়াত) এর নেতৃত্বে ডেমরা হয়ে বাড্ডা দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে জুনিয়র টাইগার্স (২ ইস্ট বেঙ্গল)। ১৬ তারিখ সন্ধ্যা নাগাদ ইউনিটটি পায়ে হেঁটে ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌছায়। সেখানেই ইউনিটটি অবস্থান নেয়। ১৭ তারিখ সকাল থেকেই ঢাকার অদ্ভুত কিছু মানুষের আনাগোনা দেখা যায়। এরা সবাই সশস্ত্র, শহরের অলিগলিতে অথবা বড় রাস্তায় হুড খোলা জিপ হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। তাদের পড়নে আধুনিক ডিজাইনের প্যান্ট, পায়ে কেডস, হাতে সবার রাইফেল অথবা স্টেনগান। লম্বা চুল, দাড়ি-গোফ আর সানগ্লাস চোখে সেই আমলের ক্রেজ বীটলস ব্যান্ডের মেম্বারদের মত বিপ্লবী বা রেবেল লুকে তারা যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে! এদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চালচলন, আচার-আচরনে যুদ্ধের ছিটে-ফোটাও ছিল না; ছিল না ৯ মাস যুদ্ধের কোন ক্লান্তি! এরাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সেই বিখ্যাত সিক্সটিনথ ডিভিশন, যারা ১৬ ডিসেম্বর রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মূলতঃ ছিল একটি জনযুদ্ধ, যার প্রধান অংশগ্রহণকারী ছিল গ্রামাঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত সহজ-সরল তরুণেরা। এদের আত্মত্যাগেই এসেছিল আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু অল্পকিছুদিনের মধ্যেই এই সাফল্য হাইজ্যাক করে ফেলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শত শত মাইল দূরে অবস্থান করা রাজনীতিবিদরা। নয় মাস সংগ্রামের ছিটে-ফোটাও গায়ে না মেখে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালু রাখা তথাকথিত অনেক বুদ্ধিজীবি, শহুরে এলিট আর সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তরাই আরাধ্য এই বিজয়ের বিজয়মাল্য গলায় ঝুলিয়ে ফেলে!

১৭ ডিসেম্বর দুপর থেকেই ২ ইস্ট বেঙ্গলের সদস্যরা আরেকটি জিনিস স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে – জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) এর লুটপাট। নিউ মার্কেট সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেদিন এই লুটপাট চলে। ঢাকায় তখনও ২ ইস্ট বেঙ্গল ব্যতীত মুক্তিবাহিনীর অন্য কোন ইউনিট নেই, সম্পূর্ণ শহর তখন ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে; শহরের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বও তখন তাদের। সুতরাং, এই লুটপাট কাদের প্রশ্রয়ে আর অংশগ্রহণে হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। শুধু ২ ইস্ট বেঙ্গলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির কারনে ঢাকা স্টেডিয়াম এলাকায় ভারতীয়রা কিছু করতে পারে নি; এইটুকু চক্ষুলজ্জা তাদের ছিল! সেদিন মেজর মইন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডেপো (সিওডি) তে যান সৈনিকদের জন্য কিছু তাঁবু সংগ্রহ করার জন্য; সেটাও তখন ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি কিছু তাঁবু সেখান থেকে নিতে পারেন। কিন্তু তখনই তিনি লক্ষ্য করেন, সিওডিতে যে পরিমান রসদ থাকার কথা, তার তুলনায় অনেক কম আছে। পরবর্তী কয়েকদিন তিনি যতবার সেখানে গিয়েছেন, রসদের পরিমান দিনদিন কমতেই থাকে। এই সময় পাকিস্তানিদের চার ডিভিশন সমপরিমান হালকা ও ভারী অস্ত্রপাতি, সরঞ্জামাদি ও যানবাহন ভারতীয়রা পাচার করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালে মান্ধাতা আমলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কিছু আর্টিলারি কামান তারা ফেরত দেয়।

বিজয়ের ঠিক এই সময়টাতেই আরেকটা জিনিস বেশ লক্ষণীয় ছিল। ঢাকার সেই সময়কার অবস্থাপন্ন ও ধনাঢ্য অনেক পরিবারের সাথে ভারতীয় বাহিনীর অনেক অফিসারের বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। কুলীন পরিবারগুলোর জন্য তখন ভারতীয় বাহিনীর অফিসারদের বাড়িতে দাওয়াত করাটা বেশ একটা স্ট্যাটাস সিম্বলে পরিণত হয়েছিল। এসমস্ত বাড়িতে গেলেই গৃহকর্তারা ‘কর্ণেল মিত্র’ অথবা ‘মেজর বাজওয়া’ দের ডিনার করতে আসার গল্প শুনিয়ে বেশ পুলক অনুভর করতেন। নিজ দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাল-হকিকত জানার মত সময় তাদের ছিল না। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন সিনিয়র টাইগার্স (১ ইস্ট বেঙ্গল) এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম, বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অধ্যক্ষ) মন্তব্য করেছিলেন, “এই হল বাঙ্গালিদের চিরাচরিত মানসিকতা। এরা যুগ যুগ ধরে এভাবেই বিজয়ী বিদেশি শক্তিকে আপ্যায়ন করেছে।” মজার ব্যাপার হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই মানুষগুলোর অধিকাংশই স্বাধীনতাবিরোধী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয়টা মাস পাকিস্তানি অফিসারদের সাথেও তাদের ঠিক একই রকম খাতির ছিল। ১৬ ডিসেম্বরের আগের নয় মাস একইভাবে তারা দাওয়াত করে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের আপ্যায়ন করত।

মাত্রাতিরিক্ত এজাতীয় তোষামোদের কারনে ভারতীয় সেনা অফিসারদের মধ্যে নিজেদের বাংলাদেশের ত্রাতা ভাবার প্রবণতা চলে আসে। তাদের ঔদ্ধত্য আর স্বেচ্ছাচারিতা ছিল দেখার মত! জেনারেল অরোরা ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তী দুই-তিন মাস যতবার ঢাকায় এসেছেন, ততবারই ক্যান্টনমেন্টের ‘কমান্ড হাউজ’ এ তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হত। স্বাধীনতার আগে এটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানস্থ প্রধানের বাসভবন। ঢাকায় গাড়িতে চলাফেরা করার সময় তার গাড়িতে শোভা পেত ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের পতাকা, তিনি যে আরেকটি স্বাধীন দেশে এসেছেন; সেদিকে তাঁর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না! তার চলাফেরার সময় রাস্তার স্বাভাবিক যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হত, যেমনটা করা হয় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের সময়। এই বিষয়ে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্ত এতটাই বিব্রত হয়েছিলেন যে তাকে শেষ পর্যন্ত এটা বন্ধে হস্তক্ষেপ করতে হয়।

অফিসাররা যা চিন্তা করতেন, ভারতীয় সৈনিকরাই বা তা থেকে বাদ যাবে কেন? এই ধরনের চিন্তা থেকে তারাও মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খেয়ে দাম দিত না। শুরুর দিকে দোকানিরা হাসিমুখেই তাদের ফ্রিতে মিষ্টি খাওয়ালেও, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটাকে তারা নিজেদের সহজাত অধিকার ভাবা শুরু করে দেয়। তখন এ নিয়ে কিছু বললে, মাঝেমাঝে নিজেদের ঔদ্ধত্য দেখানোর জন্য তারা দোকানের গ্লাস-প্লেটও ভেঙ্গে যেত। সেই আমলের অধিকাংশ মিষ্টি দোকানদার হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় এই অত্যাচারটা মূলতঃ তাদেরকেই সহ্য করতে হত। অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এদেশে আসা শুরু করেন নতুন বাজার আর লুটের জায়গা খোঁজার জন্য। অর্থনীতিকে ভারতনির্ভর করার শুরুটা সেই সময় থেকেই। এমনকি খবরের কাগজের ডিক্লারেশন নিতে চাইলেও তৎকালীন সরকারের একটা শর্ত মানতে হত – “বন্ধু দেশের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।”

বিজয়ের ঠিক পরপরই গুরুতর কিছু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার জন্য তৎকালীন পূর্ব জার্মানি সাহায্যের হাত বাড়ায়। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি একটি চার্টার্ড বিমানে করে বার্লিনের উদ্দেশ্যে ২৪ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রওনা হন। এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) হারুন আহমেদ চৌধুরী, বীর উত্তম, মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম, ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে লেঃ কর্ণেল) শরীফুল হক ডালিম, বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর) শমসের মবিন চৌধুরী, বীর বিক্রম। ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার আগে একটা বিপত্তি ধরা পড়ে। যাত্রী যেখানে ২৪ জন হওয়ার কথা ছিল; সেখানে যাত্রী দেখা যায় ২৬ জন। খোঁজাখুঁজির পর অতিরিক্ত এই দুইজন যাত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়। এদের একজনের নাম গোলাম মোস্তফা, যে কিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সুপারিশে এসেছিল। ‘কোমরে ব্যথা’র কারনে অনেক কষ্ট করে এই ব্যক্তি বিমানে উঠতে পেরেছিল; সাথে তার ভাগনে পরিচয়ে আরেকজনকেও নিয়ে এসেছিল তাকে ‘সাহায্য’ করার জন্য। এই দুজনকে নিয়েই মোট যাত্রীসংখ্যা ২৬ হয়। শেষ পর্যন্ত এই দুজনকে সহই বিমান বার্লিনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

বার্লিন যাওয়ার কয়েকদিন পর জানা যায়, এই গোলাম মোস্তফা নামক ব্যক্তির আঘাত মোটেই তেমন গুরুতর নয়; প্রায় পুরোটাই তার অভিনয়। অথচ, অতি নাটকীয়তা করে এই ব্যক্তি চলাফেরাও করত নার্সের কাঁধে ভর করে। ডাক্তারদের কাছ থেকে সত্য জানার পর এই গ্রুপের দলনেতা মেজর আমীন আহম্মেদ চৌধুরী যখন গোলাম মোস্তফাকে চাপ দিলেন, পরের দিন থেকেই তার হাঁটাচলা স্বাভাবিক হয়ে গেল। শুধু তাই না, নিজ ভাগনেকে বার্লিনের কোন আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের তদবির এই ব্যক্তি তখন মেজর আমীনের কাছে করে। যদিও তার কোন তদবিরেই কর্ণপাত করা হয় নি। ভাগনেসহ তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলে এই ব্যক্তি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। পরে জার্মান পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে আসে।

শেষ কথা

অতীতের পাতায় একদিনের জন্য যথেষ্ট বিচরন হল। তবে বর্তমানে ফিরেই শেষ করব। লেখার শুরুতেই যে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছিলাম, অর্থ্যাৎ সেই সময়ের সাথে বায়ান্ন বছর পর আজকের দিনের একটা যোগসূত্র টানা; সেই কথায় ফিরে আসি। আমি খুব খুশি হতাম যদি লিখতে পারতাম, ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে হতবাক মুক্তিযোদ্ধাদের আশংকাগুলো অমূলক প্রমানিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে সম্পূর্ণ অন্য কথা।

বায়ান্ন বছর আগের ১৬ ডিসেম্বর রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা যেমন অবাক চোখে দেখছিলেন ‘সিক্সটিনথ ডিভিশন’ এর দৌরাত্ম, ক্রমেই তা প্রকট হয়েছে। ৯০ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের সহজ-সরল ছাত্রজনতা আর কৃষক-মজুরের মুক্তিযুদ্ধ আজ চলে গেছে শহুরে এলিট আর সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তের দখলে। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের ধারে-কাছেও না থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে বেড়ানো আর গর্তজীবী শিক্ষিত এলিটরা এখন নির্ধারন করে কে স্বাধীনতার পক্ষে আর কে বিপক্ষে। যুদ্ধের সময় ঘরের সুরক্ষিত চৌহদ্দিতে বসে প্ল্যানচেট করে দিন পার করা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এখন সবক দেন মুক্তিযুদ্ধের কোন সেক্টর কমান্ডার অথবা ব্রিগেড কমান্ডার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। সংগ্রামের পুরোটা সময় যে সংস্কৃতিকর্মী এমনকি ছদ্মনামেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পড়তে অস্বীকৃতি জানিয়ে ভারত সরকারের বদান্যতায় সস্ত্রীক হানিমুন মুডে ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন, তিনিই এখন সাংস্কৃতিক অঙ্গণের দিকপাল। এদের মত মানুষরাই দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শেখান; অসাম্প্রদায়িকতা শেখান।

বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন কেমন হবে, সেই বিষয়ে বিতর্ক আর দেন-দরবার এখন ঢাকায় হয় না, হয় দিল্লীতে। বাংলাদেশের আসন্ন আরেকটি বিনা ভোট বা নিশী রাতের সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কে মনোনয়ন পাবে এবং মতান্তরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবে, সেই ফয়সালা এখন করে ‘বন্ধু রাষ্ট্রের’ গোয়েন্দা সংস্থা। নিজ দলের মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ কোন নেতা তাই সিদ্ধান্ত বদলের তদবির নিয়ে নিজ নেত্রীর কাছে না গিয়ে ছুটে যান বন্ধু রাষ্ট্রের দরবারে! ভবিষ্যত গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতাও তাই নিজ দলের আসন বৃদ্ধির আবদার নিয়ে ধরনা দেন বন্ধু রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দহলিজে। বন্ধু রাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা ক্রমেই সেদেশের মুদ্রায় আমাদের সাথে ব্যবসা করার ইচ্ছা আর ‘সুবিধাদি’ ব্যক্ত করে যান।

দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব এখন ব্যক্তি আর পরিবারকেন্দ্রিক; সেটাও আবার বন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট। বন্ধুকে এত দিয়েছেন, তারা তা মনে রাখবে সারাজীবন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রহরীরাও আজ নিজ স্বার্থ নিয়ে সন্তুষ্ট। পদ, পদবী, বাড়ি-গাড়ি পেলেই সবাই খুশি; কি হবে ঝামেলায় জড়িয়ে? তাদের কান্ডারিকেও দায়িত্ব নিতে হয় অকৃত্রিম বন্ধুকে আশ্বস্ত করে। প্রশাসন, বিচার – সবই এখন শিখতে হয় বন্ধুর কাছ থেকে; বন্ধুর পাঠশালায়। খেলার মাঠে বন্ধু হারলে ভুলেও তা নিয়ে উল্লাস করা যাবে না, এ যেন সাক্ষাৎ বিশ্বাসঘাতকতা! বন্ধুর বন্ধুত্বের দায় যেন শেষ হবার নয়; আমাদের চুকিয়ে যেতে হবে পদে পদে, জায়গায় অজায়গায়!

শারীরিক ও মানসিক দাসত্বের শৃঙ্খল ভেংগে বাংলাদেশ আবারও স্বাধীন হোক। আমরা আবারও বিজয়ের আনন্দে মাতি; সত্যিকারের বিজয়! সেই বিজয়ের আনন্দমিছিলে খুব শীঘ্রই দেখা হোক সবার!

মেজর শাফায়াত আহমদ (অব:)

 

তথ্যসূত্রঃ

 

১। Alan Lindquist / Military and Development in Bangladesh, IDS Bulletin – January 1977, Volume 9 Number 1

২। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম / এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশক, মওলা ব্রাদার্স – ফেব্রুয়ারি ২০০০

৩। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন / বলেছি বলছি বলব, অনন্যা প্রকাশ – সেপ্টেমর ২০০২

৪। হায়দার আকবর খান রনো / শতাব্দী পেরিয়ে, তরফদার প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারী ২০০৫

৫। এ টি এম শামসুল হুদা / ফিরে দেখা জীবন,  প্রথমা প্রকাশন – ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

৬। আলতাফ পারভেজ / মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী, ঐতিহ্য – ফেব্রুয়ারি ২০১৫

৭। মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী / বীর বিক্রম, ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন, প্রথমা প্রকাশন – জানুয়ারি ২০১৬

৮। হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম / সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পচাত্তর, প্রথমা প্রকাশন – ফেব্রুয়ারি ২০২০

 

Facebook
Twitter
LinkedIn