তারেক রহমানঃ বিএনপি কেন নির্বাচন বয়কট করছে

দ্যা ডিপ্লম্যাট, ১৮ ডিসেম্বর

বাংলাদেশে আগামি ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তম বিরোধী দল সে নির্বাচন বয়কট করেছে এবং তারা বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন আয়োজন সম্ভব না। সেকারনে গত বছর থেকেই তারা দেশজুড়ে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। স্নিগদেন্ধু ভট্টচার্যের সাথে এক সাক্ষাতকারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন কেন তারা নির্বাচন বয়কটের পথ বেছে নিলেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক বাংলাদেশে ২০০৬-৭ সালে ১৮ মাস জেলে থাকার পর বর্তমানে লন্ডনে আশ্রয়ে আছেন।

এই সাক্ষাতকারে তারেক রহমান আলাপ করেছেন তার দলের নীতি-কৌশল, একটি নিরপেক্ষ স্বাধীন নির্বাচনের সম্ভাব্যতা এবং ভৌগলিক সমীকরণ। তারেক রহমানও আরো বলেন, ভারত বিএনপির সাথে জামায়তের সম্পর্ক নিয়ে যা ভাবে তা সমস্যাক্রান্ত, কেননা আওয়ামিলীগের  ইসলামি দলগুলোর দহরম মহরমের ইতিহাস আছে।

 

কেন বিএনপি আসলে এই নির্বাচন বয়কট করলো?

তারেক রহমান: না, একা বিএনপি নয়, আরো ৬২টি গণতান্ত্রিক এই তথাকথিত নির্বাচন বয়কট করেছে। এই সিদ্ধান্তের পিছনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা। আমাদের দায়বদ্ধতা আছে,  একটি অর্থবহ স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা যেখানে ভোটাররা নির্বিগ্নে তাদের ভোটদান করতে পারে। অপিরদিকে হাসিনার অধীনে নির্বাচনের যে কলংকের ইতিহাস সেটি ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের সবার জানা। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে কোনো নির্বাচন দেয়নি। ২০১৮ সালে ব্যালট বাক্সগুলো াগের রাতে ভরে রেখে গনতন্ত্রের সাথে রীতিমত মশকরা করা হয়েছে। এবার ২০২৪ সালে আরেকটি কুখ্যাত নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে যেসব দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তাদের সাথে আসন ভাগবাটোয়ারাও শেষ করেছে তারা। এই নির্বাচনে তাদের সবচেয়ে বড় জোটবন্ধু হল, এরশাদের জাতীয় পার্টি, যাদের কিছুটা জনভিত্তি আছে। বাকিদের জনগণের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক গ্রহনযোগ্যতা নেই। এমনকি জাতীয় পার্টির ঘরোয়া বৈঠকে তাদের নেতাকর্মীরা এই নির্বাচন বয়কট করার আহবান জানিয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম পরবর্তীতে আওয়ামি লীগ তার রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যয় করে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের মাঠে নিয়ে এলো।  এই একই নির্বাচনে শেখ হাসিনা তার দলীয় নেতাকর্মীদের ডামি প্রার্থী বানাতে আদেশ দিলেন যাতে নির্বাচন যথেষ্ট প্রতিযোগিতাপূর্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্য হয়। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কিংস পার্টিকেও ব্যবহার করছে যেহেতু তারা বিএনপিকে ভাংতে পারেনি। সেখানেও আওয়ামালীগের আসন বন্টন নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে, যেমন জাকের পার্টি তাদের ২০০ প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে। এছাড়া আরো অনেক ছোট দল তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বাধায় তা হয়নি। এর আগে উপনির্বাচনগুলোতে পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিটা নির্বাচনেই বিরোধী পক্ষের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে, ভোটার লিস্টে জালিয়াতি, ভুয়া ভোটার এবং ব্যালট বাক্সে হেরফের করা হয়েছে। গত মাসের এক উপনির্বাচনে একজন সরকার দলীয় এজেন্টকে ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩টা ভোট দিতে দেখা গেছে। এতেই পরিস্কার হয়, হাসিনা যেকয়দিন ক্ষমতায় আছে, ততদিন একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচন একটি দূরবর্তী স্বপ্ন মাত্র। আপনারা দেখছেন, নির্বাচন যত কাছাকাছি চলে আসছে বিরোধী পক্ষের ওপর নির্বাচন ততই বাড়ছে এবং এতেই প্রমাণিত হয় যে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোন পরিবেশ তৈরি হয়নি। জেলখানাগুলো ইতিমধ্যে ভরে যাচ্ছে তারপরেও যেনতেনভাবে ভুয়া মামলায় ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ঘটছে মানবাধিকারের বিরুদ্ধে কর্মকান্ড যেমন গুম,  অত্যাচার।  ফলে এটি সকলের কাছে দৃশ্যমান যে, একটি গ্রহণযোগ্য স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আয়োজন করা উচিত এবং এতেই সকলের ভোটের অধিকার ফিরে আসতে পারে।

নতুন সরকার ক্ষমতায় চলে আসলে বিএনপির রাস্তার আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কিনা বা আগ্রহ কমে যেতে পারে কিনা?

তারেক রহমান: শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে, আপনারা জানেন ইতিমধ্যে ২৬২৭ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এছাড়া ৬৭৫ জনের গুম  হওয়ার প্রমাণের নথি আছে, ইতিমধ্যে এক লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং এতে আসামি করা হয়েছে বিএনপি এবং অন্যান্য দলের অন্তত ৫০ লাখ লোককে।  আমাদের ২৮ শে অক্টোবরের সমাবেশের পরে  অন্তত ২২ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। বর্তমানে জেলের ধারন সংখ্যার আড়াইগুনের পরেও গ্রেপ্তার করার হার কমছে না। বিএনপি এ সরকার কর্তৃক এহেন নিপীড়নের পরেও টিকে আছে। এটি সাক্ষ্য দেয় আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ। সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে আমরা মনে করি আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।  এতে যদি শেখ হাসিনা ও ক্ষমতায় আসে তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং এর পিছনে আমাদের যথেষ্ট সমর্থন আছে। এছাড়া কৌশলের অংশ হিসেবে আমাদের আন্দোলনে গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হতে পারে।  যেমন বিএনপির গত ১৬ ডিসেম্বরের সমাবেশে লাখ লাখ নেতাকর্মী হাজির ছিল যা প্রমাণ করে আমরা সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কতটা শক্তি অর্জন করেছে এবং আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। বেশ কিছু বছর ধরে সারা বাংলাদেশেই আমরা বিভিন্ন সমাবেশের আয়োজন করছি যেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করছে। সে এক ইতিহাসের অংশ।

 

আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উপর একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের চাপ রয়েছে। আপনি কি মনে করেন,  এই চাপ যথেষ্ট?

তারেক রহমান: আপনার প্রশ্নেই আপনার উত্তরটি রয়েছে বর্তমানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোন পরিবেশ নেই।  অর্থাৎ আমরা নীতিগত জায়গা থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না।  আপনারা জানেন ইতিমধ্যে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছে যে এক রাতে সকল নেতাকে ছেড়ে দেওয়া হবে এর বদলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে।  রাজ্জাক সাহেব আরো বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে রাখা একটি পরিকল্পনার অংশ।  রাজ্জাক সাহেবের বক্তব্য প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক গ্রেফতার ও বিচারিক নিপীড়ন এর উপর ভিত্তি করে নির্বাচন পরিচালনা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের সকল কার্যকর অঙ্গ গুলোকে ইতিমধ্যে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে এবং এর মধ্যে আছে বিচার বিভাগ, পুলিশ, সিভিল ও মিলিটারি আমলাতন্ত্র। নিজেদের পক্ষের লোকদের আরো সহায়তা করা হচ্ছে এবং কোন নির্দেশ মানা না হলে কি করতে পারে তাও স্পষ্ট করা আছে।  ভুয়া পর্যবেক্ষক ও নির্বাচনের আগে সরকারি নিপীড়ন এর ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নীরবতা প্রমাণ করে এই কমিশন বিশ্বাসযোগ্য নয়।  নির্বাচনের আগে অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশকেও সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণার বাইরে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার আদেশ মারাত্মক সমস্যাক্রান্ত এবং এতে সকলের জোটবদ্ধ বা একত্রিত হওয়ার এবং মত প্রকাশ করার নাগরিক অধিকার খর্ব হয়।  এবং এটি আরো স্পষ্ট করে যে, শেখ হাসিনার নির্বাচন কমিশনার উপর প্রভাব কতটুকু।

 

২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে আন্তর্জাতিকভাবে শেখ হাসিনাকে খুব বেশি বিপদে পড়তে হয়নি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে বিএনপি আশা করছে যে নির্বাচনে হাসিনাকে দুর্বল করা সম্ভব হবে?

তারেক রহমান: বর্তমানে বাংলাদেশে একটি দূর্নীতিবাজ এক দলের শাসন চলছে। সাথে আছে দেশের ফুলে ফেপে উঠা কিছু ব্যবসায়ী আর সারা দুনিয়ার গনতন্ত্রবিরোধী কিছু দেশ। শেখ হাসিনা কেবলমাত্র গনতান্ত্রিক দেশগুলোর বিরুদ্ধে নানা রেটরিক ব্যবহারই করেনা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিতর্কিত আচরণ করে থাকেন। ্তিনি আন্তর্জাতিক সব আহবান এক তুড়িতে উড়িয়ে দেয়। গনতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে গনতন্ত্র ও মানবাধিকার সবসময় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, ফলে বাংলাদেশের  জনগনের গনতন্ত্রের জন্যে লড়াই এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের লক্ষ্য যেন আজ এক মোহনায় এসে মিলেছে। আমরা তাই আন্তর্জাতিক বিশ্বের উন্নয়নের অংশীদার যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান আরো যারা বাংলাদেশের জনগনের এই লড়াইয়ে আছেন, তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। ইতিমধ্যে আমেরিকার র‍্যাবের উপর স্যাংশন, ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ সরকারের প্রতি তাদের গনতান্ত্রিক আহবানকে বাংলাদেশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে।

 

হাসিনা আবারো ক্ষমতায় চলে এলে বিএনপির কর্মপন্থা কি হবে? ভোট পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিএনপি কি জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না?

তারেক রহমান: মোটেও না। কারন ভোটাররা ইতিমধ্যে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপির বয়কটের সিদ্ধান্ত ছিল জনগনেরই ইচ্ছার প্রতিফলন। প্রকৃতপক্ষে আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামিলীগ বরং এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিজম কায়েম করে তারাই জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একজন গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক থেকে সুশীল সমাজ, ছাত্র থেকে চাকরিজীবী; সমাজের প্রত্যেকটা অংশ আজ গনতন্ত্র ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। বিএনপির লোকেদেরও মানবাধিকার থাকছেনা। তাই আমরা মনে করি, আমাদের হাসিনা হটাও- এর এক দফা মূলত ২০ কোটি জনগনের মনের কথা। আমরা এর বাইরে ৩১ দফাও দিয়েছি বাংলাদেশেএ আগামিদিনের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল নিয়ে। আমরা মনে করি নির্বাচন নামের ভাগবাটোয়ারাতে কেউ যাচ্ছেনা এর পেছনে গনতান্ত্রিক দলগুলোর বাইরে জনগনেরও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সর্বশেষ দুটি নির্বাচনে বাংলাদেশের ১২ কোটি ভোটার এবং প্রায় তিন কোটি তরুণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি।

ফলে জনগনের ইচ্ছা আকাঙ্খা এবং ভোটাধিকারের জন্যে বিএনপির লড়াই আজ একই জায়গায় এসে মিলেছে। আজ দুপক্ষের যৌথ উদ্দেশ্য হল, দলমত লিংগ জাতি নির্বিশেষে জনগনের জন্যে স্বাধীনতা, সাম্য, উন্নয়ন নিশ্চিত করা।

 

 

আওয়ামিলীগের নেতাকর্মীরা বলছে, বিএনপি এই নির্বাচন বয়কট করছে কারন বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা অনেক। আপনাদের অধিকাংশ নেতাদের জেলে থাকাও কি নির্বাচন বয়কট করায় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে কিনা?

তারেক রহমান: যদি নেতাকর্মী, সমর্থকদের সংখ্যার হিসেবে যাই, বিএনপি বাংলাদেশের বৃহত্তম জনপ্রিয় দল। সাংগঠনিক শক্তিতে কুলিয়ে না উঠতে পেরেই আওয়ামিলীগ এবং হাসিনা রাষ্ট্রীয় শক্তিকে ব্যবহার করে নিপীড়ন চালাচ্ছে। আমাদের উচ্চপদস্থ নেতা থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মী, সবাইকে গ্রেফতার করছে তারা। বিএনপির জনগনের শক্তিতে বলীয়ান হওয়ায় এবং আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্নতাই হাসিনাকে এমন সব ষড়যন্ত্র করতে হচ্ছে যাতে বিএনপি এসব নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। বিএনপির অসংখ্য সিনিয়র নেতাকে দুই বা তার অধিক বছরের কারাদণ্ড দিচ্ছে, যাতে তারা আইন অনুযায়ী আর নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। ভুয়া মামলার উপর দেয়া এসব পক্ষপাতদুষ্ট রায়ের সাথে আবার সরকারের লোকজনদের অগ্নিকান্ড ঘটানো এবং বিএনপির নামে কল্পিত ঘটনা তৈরি করার সম্পর্ক আছে বলেও আমরা মনে করি। জেলে থাকাও আজকাল আর নিরাপদ নয়, কারন জেলে অসংখ্য নেতাকর্মীর অজানা মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আওয়ামি সন্ত্রাসী এবং পুলিশের যৌথ আক্রমণ, ঘরে হামলা, হত্যা আজ আমাদের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে বাড়িহারা করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই নেতাকর্মীদের বাড়িতে না পেলে তার মাবোনসহ পরিবারের ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও হয়রানির ঘটনা ঘটছে।

 

আওয়ামিলীগের নেতারা বলেন, বিএনপিই ২০০৬-০৮ এ তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আপনার মতামত কি?

তারেক রহমান: ১৯৯৬ সালে এই বিএনপি সরকারই তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে যুক্ত করে। একটি স্বাধীন মুক্ত নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে সকল দলগুলো তখন একমত হয়েছিল। যাই হোক, ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তারা সেটি বাতিল করে যাতে একদলীয়ভাবে সারাজীবন দেশের ক্ষমতা ধরে রাখা যায়। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের এমিকাস কিউরিদের অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক দল, অবসরপ্রাপ্ত  বিচারক, আইনজীবী, সুশীল সমাজ, এবং সম্পাদকদের সাথেও বৈঠক করেছিল তখনকার সংসদীয় কমিটি। সেখানেও একই কথার প্রতিধ্বনি ছিল। কিন্তু একক ব্যক্তি শেখ হাসিনার কথায় সকলের মতামতকে উপেক্ষা করে সংসদকে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের আদেশ দেয়া হয়।

 

ভারতের একটি বিশেষ দুশ্চিন্তার জায়গা হল, বিএনপির সাথে ইসলামী দলগুলোর জোট বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশ বিএনপির সময়ে অনেক বেশি পাকিস্তান ঘেষা ছিল এবং তারা ভারতের নিরাপত্তার বিষয়ে তেমন আগ্রহী ছিল না। আপনার মতামত?

তারেক রহমান: বিশাল দল হিসেবে বিএনপি মনে করে ব্যক্তির ধর্ম থাকতে পারে কিন্তু রাষ্ট্র হবে সকলের। এবং বাংলাদেশে প্রত্যেকে তার প্রাপ্য অধিকার পাবে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমাদের কঠিন নীতি আছে। আসলে ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান, আমাদের এই তিনটি দেশেই ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করার অনুমতি দেয় খোদ সংবিধান। ফলে এই তিন দেশেরই উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় দল আছে। যেমন ভারত জামায়াতের ব্যাপারে বেশ চিন্তিত। কিন্তু এটিও দেখার বিষয় আছে যে জামায়াতের সাথে আওয়ামিলীগেরও দীর্ঘ রাজনৈতিক বন্ধুত্বের ইতিহাস আছে। ১৯৬৬-৭০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত একসাথে আইয়ুব বিরোধী সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। ১৯৮৬ সালে এ দুটি দলই এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে একজন স্বৈরশাসককে বৈধতা দিয়েছে। এমনকি ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে এ দুটি দল মিলে গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দল বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তাহলে জামায়াত যখন আওয়ামী লীগের সাথে আন্দলন করেছে, তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা কেবল তখন যখন বিএনপি জামায়াত এক জোট হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করছে?

অপরদিকে ভারতের উদ্বেগের বিষয় যদি হয় ইসলামি রাজনীতি, তাহলে এটি উল্লেখ করার দরকার যে ২০০৬ সালে হাসিনা ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে একটি লিখিত চুক্তি করেছিল। হাসিনা তার দলের মধ্যেও উগ্র ইসলামপন্থীদের জায়গা দিয়ে থাকে। সম্প্রতি একেএম বাহাউদ্দিন নামে এক সিনিয়র আওয়ামি নেতাকে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে কিভাবে দুর্গাপূজার আয়োজন করতে হবে এ বিষয়ে জ্ঞান দিতে দেখা যায়, পরে তাকে ক্ষমা চাইতে বললেও সে তা করেনি। বরং তার নেতাকর্মীরা স্থানীয় প্রতিবাদী হিন্দুদের উপর হামলা চালায়। হিন্দু নেতাদের আপত্তি স্বত্ত্বেও তিনি আবারো এই ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। অপরদিকে আমাদের ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্রাটেজির কারনে সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং চরমপন্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হব আমরা। আমরা বাংলাদেশের মাটিকে অন্য কোনো দেশের নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হতে পারে এমন কাউকে ব্যবহার করতে দিব না।

 

আপনি ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করছেন, শেখ হাসিনা হত্যা মামলাসহ বেশ কিছু মামলায় আপনি দন্ডপ্রাপ্ত আসামী। বর্তমান সরকার আপনাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। আপনার মতামত বা খবর প্রচারেও আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। এমতবস্থায় আপনি দলকে কিভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন?

তারেক রহমান: শেখ হাসিনার সাথে বিরোধের পর সাবেক প্রধান বিচারপতির দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া প্রমান করে বাংলাদেশে কতটুকু বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতা আছে এবং আদালতের বাইরে থেকে আদালতকে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়।  আরেকটি ঘটনায়, বিচারক মোতাহের হোসেন অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে হাসিনার পক্ষ থেকে নানা চাপ সত্বেও তিনি আমাকে একটি মামলায় খালাস দেন। পরে সেই বিচারককে তার রায়ের জন্যে জীবন বাচাতে দেশ ছাড়তে হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, হাসিনার শাসনামলের বার্তা খুব স্পষ্ট; বিচারকদের চাকরি টেকাতে হলে পরিকল্পিত সাজা দিয়ে সরকারের পাশে থাকতে হবে। একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এক্ষেত্রে হল, আব্দুল কাহার আকন্দ। তিনি শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশের বড় কয়েকটি আলোচিত মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। আপনি যেই মামলার কথা উল্লেখ করলেন সেখানে তার তদন্তের উপির ভিত্তি করেই আমাকে সাজা দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি ঘটার অন্তত ৭ বছর পর ভুয়া প্রমানাদি দিয়ে আমার নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আব্দুল কাহার আকন্দ তারপর অবসরে চলে গেলেও সম্প্রতি তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিশোরগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচন করছে। এভাবেই হাসিনার প্রতি শর্তহীন আজ্ঞাবহ থাকার পর সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পুরস্কার গ্রহণ করার ব্যাপারটিকে আমি মারাত্মক অশুভ বলেই মনে করি। হাসিনা শুধু আমাকে মিথ্যা মামলা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছে তাই কেবল নয়, আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও ভুয়া মামলা করেছে যে কিনা রাজনীতির সাথে কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয়। হাসিনা আমাদের বাংলাদেশের সম্পত্তি দখল করেছে, আমার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জেলে রেখেছে এবং তিন দশক ধরে পারিবারিক বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে। এটি আমাদের জন্যে মারাত্মক বেদনাদায়ক যে এই বয়সেও আমার মা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না। আমরা কেবল বাংলাদেশের গনতন্ত্রের জন্যে এই ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছি এবং এক্ষেত্রে আমাদের প্রেরণা বাংলাদেশের হাজারো পরিবার যারা এই সংগ্রামে আমাদের পাশে আছেন। নির্বাসনে থাকলেও আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু পার করি ফোনে এবং অনলাইন মিটিং এর মাধ্যমে সকলের সাথে যুক্ত থেকে। আমি দেখি, আমাদের নেতাকর্মীরা জেল থেকে বের হওয়ার পর দ্বিগুন সাহসী হয়ে যায়। জেল থেকে বের হয়ে পরের দিনই তারা মিছিল মিটিং এ যুক্ত হয়, জীবনের ঝুকি নিয়ে, শুধু এ দেশের জন্যে। আমি এসব নেতাকর্মীদের দেখে ব্যাপক অনুপ্রাণিত হই।  আমার জায়গা থেকে আমি চেষ্টা করি সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, তৃণমূলকে সাহস জোগানো এবং আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে আরো শক্তিশালী করা। আমাদের সকলের একক লক্ষ্য হল হাজার প্রতিকূলতা ও কষ্টের মধ্যেও আবার আমরা স্বাধীন জাতি হব এবং এক্ষেত্রে গনতন্ত্রের জন্যে লড়াই হল সবচেয়ে দামি।

 

Facebook
Twitter
LinkedIn